.

মানবাধিকার সংরক্ষন ও রক্ষায় সকলের করণীয়



সম্পাদনায় ঃ তথ্য সম্পাদক- শাহ্‌ মোঃ সাজেদুর রহমান (ভারপ্রাপ্ত)
মানুষের কল্যাণের জন্যই সমাজ, রাষ্ট্র, আইন ও বিচারব্যবস্থার সৃষ্টি। আইন ও বিচারব্যবস্থা এবং আইনের শাসনের পূর্বশর্ত হচ্ছে মানবাধিকার বাস্ত্মবায়ন। মানবাধিকার বিশ্বজনীন। মানবাধিকারের অর্থ মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোসহ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য স্বীকৃত বিভিন্ন অধিকার। জন্মগত ও প্রকৃতিগতভাবে সেসব অধিকার মানুষের স্বাভাবিকভাবে ভোগ করার কথা।

জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে মানুষের সহজাত অধিকারের কথা সন্নিবেশিত হয়েছে। জাতিসংঘ বর্তমানে মানবাধিকারের প্রশ্নকে অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার হরণ বা সুশাসনের অনুপস্থিতির জন্য অনেকগুলো বিষয়ই যৌথভাবে সম্পৃক্ত। আমাদের দেশের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তির প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক, যন্ত্রণাদায়ক আচরণ করা যাবে না।' দুঃখজনক হচ্ছে, যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো কু-আচরণের শিকার হন, যদি মাবাধিকারের ক্ষেত্রে সংবিধানের কোনো ধারা লঙ্ঘিত হয়, তাহলে আদালত পর্যন্ত্ম গিয়ে নিজেকেই প্রমাণ করতে হয় যে, সে সংক্ষুব্ধ হয়েছে। আদালতে এটা প্রমাণিত হলেও তার অধিকার হরণের জন্য দায়ীরা আইনের ফাঁক গলে উচ্চ আদালত থেকে বেরিয়ে আসেন। তবে আশার কথা দেশে বেশ কিছু সংখ্যক মানবাধিকার সংগঠন গড়ে উঠেছে এবং সুশীল সমাজ সক্রিয় রয়েছে।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা
দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য সরকার কর্তৃক মানবাধিকার কমিশন গঠন বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এছাড়াও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে থাকবে। কেননা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন ও পৃথক বিচার বিভাগ।

আমাদের দেশে মানবাধিকার আন্দোলন বেগবান করতে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বিএইচআর এফসহ বেশকিছু সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। এ সকল সংগঠন অধিকার সম্পর্কে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যক্রম ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ডে অবদান রাখছে।

সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকার সংগঠনসমূহের সোচ্চার ভূমিকার কারণে পৃথক আইনে শিশু অপরাধীদের বিচার ও বিনা বিচারে দীর্ঘদিন কারাগারে আটক ব্যক্তির মুক্তি লাভ সম্ভব হয়েছে। আমাদের দেশে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার। সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, যৌতুক নিরোধ আইন, শ্রম আইন এসিড অপরাধ দমন আইন, পারিবারিক আদালত আইন, নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ আইনসহ বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। কোনো ব্যক্তি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলে দেশে প্রচলিত দণ্ডবিধি আইনে তার প্রতিকার লাভের বিধান রয়েছে। তবে, নারী ও শিশু গুরম্নতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে থাকে।

নারী ও শিশু নির্যাতন রোধের জন্য দেশে প্রণয়ন করা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সর্বশেষ সংশেধনী ২০০৩)।
এ আইনে যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, পাচার, অপহরণ প্রভৃতি মানবাধিকার হরণকারী অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্ত্মি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। পারিবারিক সহিংসতা রোধেও আইন পাশ হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের বীভৎস আচরণের আরেকটি দিক হচ্ছে এসিড নিক্ষেপ, যা গুরম্নতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ ঘটিয়ে থাকে। এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২-এ এসিড নিক্ষেপে ঝলসে দেয়ার অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্ত্মি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।

এছাড়াও দেশে প্রচলিত শ্রম আইন ২০০৬-এর মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সংরক্ষণ এবং তা লঙ্ঘনে প্রতিকারের বিধান রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়েরকৃত মামলাসমূহ পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি নির্যাতনে পুরম্নষকে ইন্দন দিয়ে থাকে আরেক নারী। তাই এক নারীর প্রতি অপর নারীর মানবিক ও সহানুভূতিশীল মনোভাব তৈরির জন্য মানবাধিকার ও নারী সংগঠনসমূহ নারী সমাজের মধ্যে কাউন্সিলিং পরিচালনা করতে পারে।

ফৌজদারি অপরাধের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে ফৌজদারি মামলার সুতিকাগার হচ্ছে থানাসমূহ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানায় এজাহার দায়েরের মাধ্যমে ফৌজদারি মামলার সূত্রপাত ঘটে এবং পুলিশের তদন্তে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আদালতে মামলাসমূহের বিষয়ে কার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। ফৌজদারি মামলার মূল ভিত্তি এজাহার দুর্বল হলে, মামলার ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। নিরপেÿ তদন্ত্মের অভাবের কারণে মামলার চার্জশিটে প্রকৃতি ঘটনা প্রতিফলিত হয় না। ফাঁকফোকর দিয়ে আসামী পার পেয়ে যায়।

অপরাধিকে প্রতিপক্ষেকে ঘায়েল করতে মিথ্যা/অতিরঞ্জিত মেডিকেল সার্টিফিকেটে বা থানা পুলিশকে 'ম্যানেজ' করে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতাও ব্যাপকহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ ঘটিয়ে থাকে। সাক্ষয-প্রমাণে মিথ্যা মামলায় নিরীহ ব্যক্তি খালাস পেলেও মামলা চলাকালে তাকে পদে পদে চরম মানসিক ও আর্থিক ভোগান্ত্মির শিকার হতে হয়। মিথ্যা মামলা চালাতে গিয়ে অনেক পরিবারকেই নিঃস্ব হয়ে পথে বসতে হয়।

আবার, প্রকৃত নির্যাতনের ঘটায় প্রদত্ত মেডিকেল সার্টিফিকেটে আঘাতের প্রকৃতি ও ধরন সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। এই দুই ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা মানুষের ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মানবাধিকার রক্ষায় সুপারিশমালা
মানবাধিকার সংরক্ষণ ও রক্ষায় করণীয় প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত সুপারিশমালা বাস্তবায়ন অতি জরম্নরি। এগুলো হচ্ছে-
(১) নারী ও শিশুর অধিকার লঙ্ঘনজনিত ফৌজদারি অপরাধের ঘটনায় দ্রুততার সঙ্গে উপযুক্ত ধারায় মামলা দায়ের করতে হবে।
(২) দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে মামলার তদন্ত কার্য সম্পন্ন করে বিজ্ঞ আদালতে রিপোর্ট দাখিল করার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৩) প্রয়োজনে নারী ও শিশুর অধিকার লঙ্ঘনজনিত ফৌজদারি অপরাধের জন্য আলাদা তদন্ত্ম সংস্থা গঠন করতে হবে এবং বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে এর শূন্যতা পূরণ করতে হবে।
(৪) মামলার আলামত ও প্রমাণাদি সময় ক্ষেপণ ব্যতিরেকে সংগ্রহপূর্বক যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
(৫) দ্রুত এর সঙ্গে ভিকটিমের ডাক্তারী পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে।
(৬) মামলার বিচারকার্য যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে।
(৭) বিচার চলাকালীন সময়ে ভিকটিম ও সাক্ষীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৮) অভাবগ্রস্ত ও দারিদ্র নির্যাতিতদের লিগ্যাল এইড সাপোর্ট প্রদানের সঙ্গে প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
(৯) প্রকৃতি সত্য উদঘাটনের জন্য ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস-এর ব্যবস্থা করতে হবে।
(১০) ভিকটিমের জখমের চিত্র ধারণ ও অপরাধীর ছবি সংরক্ষণসহ ঘটনাস্থলের স্ক্যাচ ম্যাপ তৈরি করতে হবে।
(১১) ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে নির্যাতিতের সাক্ষ্য ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।
(১২) সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও এওয়্যারনেস প্রোগ্রামের মাধ্যমে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
(১৩) অপরাধ তদন্তে  পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
(১৪) হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
(১৫) ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
(১৬) সরকার ও প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
(১৭) বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনাত নিশ্চিত করতে হবে।
(১৮) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে প্রকৃত পক্ষে কার্যকর ও গতিশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। দুধককে শক্তিশালী করতে হবে।
(১৯) প্রশাসনের সকল প্রকার দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে।
(২০) সংবিধান স্বীকৃত অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা ও সমুন্নত রাখতে ন্যায়পাল নিয়োগ এবং এর জন্য প্রয়েজনীয় আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন করা।
(২১) সকল সরকারি অফিসে সিটিজেন চার্টার বা নাগরিক অধিকারের তালিকা টাঙানো এবং সর্বোপরি পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।
পরিশেষে বলা যায়, আইনজীবী, বিচারক, শিÿক, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও জনপ্রতিনিধিসহ সকলকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে।

1 Response to "মানবাধিকার সংরক্ষন ও রক্ষায় সকলের করণীয়"