.

যাওয়ার আগে তরুণদের যা বলে গেলেন

ঢাকা: চলে গেলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আর নেই (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। ৮৫ বছরের তার বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি দেশ ও জাতীর জন্য অনেক কাজ করে গেছেন। দেশের যুব সমাজাকে সক্রিয় করতে অনেক বক্তৃতা করেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তরুণ সমাজকে দিয়ে গেছেন অনেক পরমর্শ। বাংলামেইলের পক্ষ থেকে তার ‘চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তরুণরা নিরাশ হলে চলবে না’ শীর্ষক একটি বক্তব্য তুলে ধরা হলো:

গত ৭ ডিসেম্বর ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তরুণ গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে এ বক্তব্য দেন তিনি-

তোমরা সবাই পরিণত। নিজ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। তোমাদের রাজনীতি না করার পরামর্শ দেয়ার মতো বোকা নই। আমি এও জানি, শিক্ষাঙ্গনের চারপাশে যখন অস্থিরতা বিরাজ করে, তখন শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের পক্ষে নীরবে বসে থাকা সম্ভব নয়। আমি রাজনীতির বিপক্ষে নই। কোনো সমাজের উন্নতি করতে হলে অবশ্যই রাজনীতি থাকতে হবে। রাজনীতিকরা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তারা আমাদের কথা শোনেন। তারা আমাদের বন্ধু ও পথপ্রদর্শক।

আমি আশা করি, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তোমাদের নিরাশ করবে না। হতাশ হয়ো না। সাইক্লোন ও সিডরের মতো এসব প্রতিকূলতাও একসময় কাটিয়ে উঠব আমরা। রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘকাল থাকতে পারে না। জীবনের পথচলায় প্রতিটি বাধাই তোমরা দূর করতে পারবে। তোমরা বিজয়ী হবেই।

তরুণ গ্র্যাজুয়েটরা, স্বাগতম। তোমাদের পিতা-মাতা ও অভিভাবকদেরও স্বাগতম। আজ পর্যন্ত তোমাদের পিতা-মাতা ও অভিভাবকরা কী রকম উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন তা তোমরা কেবল তখনই বুঝতে পারবে, যখন তোমরা পিতা-মাতা ও অভিভাবক হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও জানাই স্বাগতম। তরুণ গ্র্যাজুয়েটরা, তোমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে মনে রেখো এবং এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি তোমাদের প্রয়োজনীয় সমর্থন দিও।

একজন কৃষকের প্রপৌত্র, একজন কৃষক-রেশম ব্যবসায়ীর পৌত্র এবং জেলা আদালতের উকিলের এক পুত্র আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বৃক্ততা দেয়ার জন্য উপস্থিত। অবশ্যই বলতে পারেন আপনারা অনেক দূর এসেছেন। এই সুদীর্ঘ পথের একমাত্র পাথেয় ছিল শিক্ষা। আমি সর্বান্তকরণে হোরেস মানের (১৭৯৬-১৮৫৯) বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করছি- ‘মানবপ্রসূত সবকিছু উপায়-উপকরণ ছাড়িয়ে শিক্ষাই মানুষের অবস্থায় সমতা আনয়নে এক বিরাট বিষয়। সামাজিক যন্ত্রের স্পন্দন নিয়ন্ত্রক চক্রবিশেষ’।

১৯৬০ সালে আমেরিকান অর্থনৈতিক সমিতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট থিওডর শুলজৎ শিক্ষা সম্পর্কে এক বৈপ্লবিক বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে এমন বিনিয়োগ, যা প্রয়োজনীয় মানবপুঁজি তৈরি করে।’ ১৯৭৯ সালে তিনি যখন নোবেল পুরস্কারে মনোনীত হলেন, তখনো তিনি তা পুনর্ব্যক্ত করেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় যেখানে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া হয় না, সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ একেবারেই রুদ্ধ বা সীমিত।

অনেক দিন আগে, ১৯৫৯ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘এমন কোনো সভ্য দেশ নেই, যেখানে একটির বেশি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত।’ ব্যাখ্যা করে বললে, আমাদের দেশে এখন তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত; ধর্মীয়, ইংরেজিপ্রধান এবং সাধারণ শিক্ষা। আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ দেখিয়ে সরকার বলছে, কোনো আইন ভঙ্গ হচ্ছে না। এক অদ্ভূত ব্যাপার, সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে না পারলেও প্রায় প্রতিটি সরকার পরিবর্তন বা ক্ষমতা নেয়ার পর আমরা শিক্ষাসংক্রান্ত একটি কমিটি অথবা কমিশন পেয়েছি।

বর্তমান সময়ে শিক্ষা অধিদপ্তর বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়নে সাফল্য অর্জন করেছে। দুর্ভাগ্য, আমাদের শিক্ষার ভিত্তি খুবই দুর্বল, সম্পদ ও  জ্বালানি সীমিত। সরকারের এক জরিপে বলা হয়েছে, প্রায় ৭০ শতাংশ ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থী ঠিকমতো পড়তে, লিখতে কিংবা গুনতে পারে না। আমাদের প্রতি ৫৫ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে গর্ববোধ করে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বিশ্বের প্রায় ৬ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তার অবস্থান ৪৯৯২। আমাদের বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। ১৪৪টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১১৩।

বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির ৯৬ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা এখন মাধ্যমিকের নিচে। এখানে পুরুষ শ্রমিকের ৪০ দশমিক ৬ এবং নারী শ্রমিকের ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ কোনো শিক্ষা লাভ করেনি। অথচ উৎপাদন, ব্যাংক কারবারি এবং বিপণনের ক্ষেত্রে পড়ালেখা জানা অত্যাবশ্যক। শ্রমশক্তি শিক্ষিত হলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কয়েক গুণ বেশি হতো।

এ দুঃখ-দুর্দশার জন্য আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা কম দায়ী নন। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী নগরের কোলাহল থেকে দূরে মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা  হয়েছে। এগুলো হচ্ছে— রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শহর থেকে দূরে শান্ত-মনোরম স্থানে হওয়ায় কিছু সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে।  সমস্যাটা মূলত নগর ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে। যদি শহরে জায়গা মিলত, তবে মহানগরের ভেতর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে কোনো বাধা থাকত না।

সাধারণত আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন-ফি বৃদ্ধির বিরোধী। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন-ফি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি করি না! বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কোনো সেশনজট নেই। যারা ডিগ্রি নিচ্ছেন আর যারা দিচ্ছেন— উভয়ের মধ্যেই অবশ্য লভ্যাংশ প্রাপ্তির সমঝোতা হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যতটা না জাতীয়, ততটাই আঞ্চলিক। যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকৃত অর্থে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ এ পরিণত হয়, তবেই বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী আকর্ষণে সক্ষম হবে।

জন ডিউই তার শেষ জীবনে একটি মন্তব্য করেছিলেন, ১৯১৬ সালে যখন আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি প্রফেসরস (আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের সমিতি) প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন দুটো কমিটি গঠিত হয়। একটি কমিটি একাডেমিক ফ্রিডম ও টেনিওর বা বিদ্যালোচনার স্বাধীনতা ও অধ্যাপকদের কর্মশর্তাদি এবং অন্যটি একাডেমিক অবলিগেশন বা শিক্ষায়তনের দায়দায়িত্বের বিষয় বিবেচনার জন্য উদ্দিষ্ট ছিল। সমিতির আলোচ্য বিষয়ে বিদ্যালোচনার স্বাধীনতা ও অধ্যাপকদের কর্মের শর্ত-সুবিধাদি বহুবার উত্থিত হলেও, ডিউই স্মরণ করতে পারেননি শিক্ষায়তনিক দায়িত্ব নিয়ে সমিতি কোনো দিন কোনো আলোচনা বা বিবেচনা করেছিল কি না। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, অধিকারের কথা বলা এবং দায়িত্বের কথা এড়িয়ে যাওয়া।

অতীতে, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের আগে ও পরের সময়গুলোয় শিক্ষার্থীরা সরাসরি ভোটের রাজনীতিতে অংশ নিতেন। সে সময় তারা ভোটারদের শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। বর্তমানে সচেতন জনগণের মাঝে শিক্ষার্থীদের সেই ভোটার নির্দেশকের ভূমিকার তেমন প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়।

তবে সত্যিই যদি আমাদের কোনো অনুসরণীয় আদর্শ দরকার হয়; তাহলে সেটি হতে পারে আমাদের কৃষককুল। হরতাল-অবরোধ পালনে তার কোনো সময় নেই; এক মুহূর্ত অবসর নেই তার অযথা বাগাড়ম্বর চর্চা কিংবা রাস্তায় মানববিধ্বংসী বোমা ছুড়ে বেড়ানোর। তারা ভালো করেই জানেন, তাদের মাঠে হাল দিতে হবে, বুনতে হবে বীজ, বাছতে হবে আগাছা আর সময়মতো ফসল তুলতে হবে ঘরে। এক্ষেত্রে যেসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের লক্ষ্যের পেছনে ছুটছে, তাদের প্রধান ও প্রথম আনুগত্য থাকবে পড়ালেখার প্রতি।

বিষয়টা অনেকটা এ রকম যে, বর্বর থেকে সভ্য হওয়া; যেনতেনভাবে তীর ছোড়ার বদলে অতি বিষাক্ত ও সূচালো তীর ছুড়ে মারার মতো। আমাদের ‘সাকি ল্যাতদের’ও উন্নয়ন ঘটেছে। আমাদের এখানে আগে ছোড়া হতো বোমা; এখন ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা। অন্যদের কাছে আমরা হুজ্জত-ই-বাঙ্গাল। সোজা কথায় ঝগড়াটে বাঙালি। আমরা সংলাপ সংলাপ করে গলা ফাটাচ্ছি; কিন্তু সেটা করার কেউই নেই। আমরা সমঝোতার কৌশল আয়ত্ত করতে পারিনি। প্রাচীন আমলে যারা চীনা আমলা হতে চাইতেন; তাদের শিখতে হতো বর্ণবিন্যাস বিদ্যা ও তীরন্দাজী। এখন আমরা আমাদের উচ্চাভিলাষী তরুণদের শিক্ষা দিতে পারি কেমন করে সমঝোতা করতে হয় কিংবা মেটাতে হয় দ্বন্দ্ব। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা, সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজ সংগঠকদের সাহায্য নিতে পারে তারা।

দুর্ভাগ্যই বলতে হয় যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিন দিন মুনাফামুখী হয়ে উঠছে; আর তাই গবেষণা ও অনুসন্ধানমূলক কাজে বিনিয়োগ করার দিকে তাদের মনোযোগও কমছে। গত বছর বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১ হাজার ৮৫০ কোটি ৪২ লাখ ৭০ হাজার টাকা মুনাফা করেছে। একই বছরে গবেষণার পেছনে এসব বিশ্ববিদ্যালয় ব্যয় করেছে মাত্র ৪১ কোটি ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা, যা সামগ্রিক আয়ের মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ; আর সামগ্রিক ব্যয়ের ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। আবার এর বেশিরভাগই ব্যয় হয়েছে অশ্রেণীকৃত খাতে; যা অনেক ক্ষেত্রেই স্বচ্ছ নয়।

এদিকে ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫টি গবেষণার পেছনে এক পয়সাও ব্যয় করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দৃষ্টিতে উচ্চতর শিক্ষার উন্নয়ন নির্ভর করে গবেষণার ওপর, আর তাই এ ধরনের পদক্ষেপ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। ১৯৯২ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনেরও লঙ্ঘন এটি। তবে শুনতে ভালো লাগে যে, গবেষণা ব্যয়ের দিক দিয়ে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি) এখন দেশে তৃতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। গত বছর আইইউবি গবেষণায় ৭৮ লাখ টাকার বেশি খরচ করেছে।

বর্তমানে দেশে ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে; যেগুলো লাইসেন্স পেয়েছে ১৯৯২ সালের আইনের আওতায়। যেহেতু লাইসেন্স দেয় সরকার, তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনের অনুশাসন মোতাবেক চলছে কি না, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের ঘাড়েই বর্তায়। কিন্তু বহুমুখী কার্যক্রমের চাপ, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব কিংবা দলীয় প্রভাবের কারণেই হয়তোবা আইন লঙ্ঘনকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তার বদলে চলছে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার ক্রমাগত প্রয়াস। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই, লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই। অথচ বনানীতে আধা কিলোমিটারের মধ্যে নয়টি এবং শুধু ধানমণ্ডিতেই ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রয়েছে।

মানের ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন থাকলেও বাজারে উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণ করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। চমকপ্রদ সব নাম নিয়ে নিছক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতোই চলছে এর কোনো কোনোটি। নব্য ধনীদের মধ্যে ইদানীং একটি সংবাদপত্র, একটি টিভি চ্যানেল ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। এগুলো আজকের দিনের স্ট্যাটাস সিম্বলও। কোনো কোনো ট্রাস্টি এমনভাবে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ছেন, যেন তারা লড়ছেন তাদের পূর্বপুরুষের সম্মান ও পৈত্রিক ধানী জমি রক্ষার জন্য।

মরক্কোর রাবাতে শিশুদের শিক্ষার ওপর প্রথম ইসলামি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে দেয়া মতামতটি এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। আমার অভিমত- সব ছাত্রেরই উচিৎ, প্রথম পাঠ মাতৃভাষায় গ্রহণ করা এবং তারা প্রথমে জানবে নিজের দেশ সম্পর্কে, তারপর তাদের প্রতিবেশী এবং পরে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশ এবং সবশেষে যদিও তা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, অবশিষ্ট বিশ্বকে। তাদের জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে দারুল ইসলাম ও দারুল হারবের ধারণাগুলো গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া ঠিক হবে না। তার পরিবর্তে উচিৎ হবে দারুল আমান, দারুল আহাদ ও তাকিয়ার নীতি আঁকড়ে ধরার উপদেশ দেয়া। আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয়, ইনডিপেনন্ডেন্ট  ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস পড়ানো হয়।

তরুণ গ্র্যাজুয়েটরা, তোমরা সবাই পরিণত। নিজ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে তোমরা। আমি তোমাদের রাজনীতি না করার পরামর্শ দেয়ার মতো বোকা নই। আমি এও জানি, শিক্ষাঙ্গনের চারপাশে যখন অস্থিরতা বিরাজ করবে, তখন শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের পক্ষে নীরবে বসে থাকা সম্ভব নয়। আমি রাজনীতির বিপক্ষে নই। কোনো সমাজের উন্নতি করতে হলে অবশ্যই রাজনীতি থাকতে হবে। রাজনীতিকরা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তারা আমাদের কথা শোনেন। তারা আমাদের বন্ধু ও পথপ্রদর্শকও।

একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে তোমাদের উৎসাহ দেয়া কিংবা বলার অধিকার আমার রয়েছে বৈকি। তোমরা নিজেদের মূল কাজ— লেখাপড়াটি দায়িত্ব নিয়ে করলে নিজের, অভিভাবকদের ও শিক্ষকদের সুখী করতে পারবে। শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের আসল কাজটি করতে ব্যর্থ হলে সবার দুঃখ বাড়বে। আমাদের দেশে সুনাগরিক খুব প্রয়োজন। অনুগ্রহ করে তোমরা ঘাটতিটুকু বাড়াবে না। সুনাগরিক জাতির বড় সম্পদ। এ সম্পদ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে তোমাদের।

আশা করি, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তোমাদের নিরাশ করবে না। হতাশ হয়ো না। সাইক্লোন ও সিডরের মতো এসব রাজনৈতিক প্রতিকূলতাও একসময় কাটিয়ে উঠব আমরা। রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘকাল থাকতে পারে না। আমি আশা করি, জীবনের পথচলায় প্রতিটি বাধাই তোমরা দূর করতে পারবে। তোমরা বিজয়ী হবেই।

সর্বশক্তিমান আমাদের সহায় হোন।

0 Response to "যাওয়ার আগে তরুণদের যা বলে গেলেন"

Post a Comment