.

মৃত্যু ফাঁদে নারী শ্রমিক


বাংলাদেশের নারী পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার যেন কেউই নেই। মালিকপ সুষুম কর্মবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত না করায় কারখানাগুলোতে ঘন ঘন অগ্নিকাকেঠন্ডর ঘটনা ঘটছে। আর এ অগ্নিকাকেঠন্ডর মৃত্যুফাঁদে পডে বেড়েই চলছে নারী শ্রমিকের লাশের সংখ্যা। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে কারখানাগুলোর অগ্নিকাকেঠন্ডর পর পাওয়া তদন্দ প্রতিবেদনে অগ্নিকাকেঠন্ডর সময় কারখানাগুলোতে জরুরি বহিঃনির্গমন পথগুলো বন্ধ থাকার বিষয়টি বারবার গুরত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু এরপরও এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকার, মালিকপ ও পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সব পই বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে কর্মবান্ধবহীন ও পরিবেশের ছাড় পত্রবিহীন পোশাক কারখানাগুলোতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে শ্রমিকদের।
গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া হাজার হাজার মেয়ের দুই বেলা খেয়ে-পরে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে প্রিয়জনদের ছেড়ে প্রতি বছর ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় অবস্থিত পোশাক কারখানা য় কাজ করতে আসে। কিন্তু অর্থনীতিতে গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখার পরও কর্মেেত্র এ নারীদের সুরা বা অন্যান্য অধিকার ও দাবি-দাওয়া  আদায় এগিয়ে আসছে না সরকার, গার্মেন্ট মালিকপ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পোশাক সংগঠনগুলো। শ্রমিক নেতারা বলছেন, সরকার এ করুণ মৃত্যুগুলো দেখেও না দেখার ভান করছে। শ্রমিকদের কষ্ট সরকারের কানে পৌঁছাচ্ছে না। এ দুর্ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে একদিকে যেমন কতগুলো প্রাণের মৃত্যু ঘটছে, তেমনি বহির্বিশ্বে পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। শ্রমিক নেতারা বলছেন, পোশাক কারখানাগুলোতে কর্মবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন 'সময়ের দাবি'। একই সঙ্গে দুর্ঘটনা এড়াতে দেশের সব পোশাক কারখানা য় কাজের সম য় প্রবেশ পথ খোলা রাখার বিষয় সরকার ও সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে। দুই মাস আগেই আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডে ভয়াবহ অগ্নিকাকেঠন্ড প্রাণ হারান ১১২ জন শ্রমিক। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন নারী শ্রমিক। ঠিক তার দুই মাস পরেই এবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের 'স্মার্ট ফ্যাশন' নামের পোশাক কারখানায় আগুন কেড়ে নেয় সাতজন নারী শ্রমিকের প্রাণ। তাজরীন গার্মেন্টের মতো আগুন লাগার সময় জরুরি বহির্গমন পথ তালাবদ্ধ থাকায় মোহাম্মদপুরের কারখানাটির শ্রমিকদের এ করুণ মৃত্যু হয় এ অবস্থায় জনমনে প্রশ্ন উঠছে দেশের গার্মেন্ট মালিকপ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পোশাক শিল্পে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব নিয়ে।

বিজিএমইএ'র তথ্যে জানা যায়, দেশে তাদের সদস্যভুক্ত পাঁচ হাজারের বেশি গার্মেন্ট পরিচালিত হচ্ছে। এসব কারখানায় ৪০ লাখ শ্রমিকের ৭০ ভাগই নারী শ্রমিক। বিজিএমইএর সদস্যের বাইরেও দেশে আরও পাঁচ শতাধিক পোশাক কারখানা রয়েছে। যারা নিয়ম ভঙ্গ করে কারাখানায় কর্মবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত না করেই শ্রমিকদের কাজে নিযয়োগ দিচ্ছে। ঢাকার অনেক আবাসিক এলাকায় পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন না নিয়ে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে অনুমোদনহীন পোশাক কারখানা। এসব কারখানাগুলোতে একদিকে যেমন অগ্নিনির্বাপণ ও জরুরি বহির্গমন পথের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। তেমনি কারখানার গোডাউনে বিপজ্জনকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ভয়াবহ দাহ্য পদার্থ। যা অগ্নিকাকেঠন্ডর দুর্ঘটনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সরেজেমিন ঘুরে দেখা যায় যে, ঢাকার পোশাক কারখানাগুলোর অধিকাংশই অপরিসর জায়গায় নির্মিত। কাজের সময় অধিকাংশ কারখানারই জরুরি বহির্গমন পথ বন্ধ রাখা হয় কারখানাগুলোতে আলো-বাতাস যাতায়াতের ব্যবস্থা না থাকায় বদ্ধ পরিবেশে দীর্ঘণ কাজ করার জন্য পোশাক শ্রমিকরা রয়েছেন ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। এ নিয়ে শ্রমিকরা লাগাতার আন্দোলন করলেও মালিকরা শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার মুখে শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেননি। সংশ্লিষ্টরা জানান, অগ্নিকাকেঠন্ডর সময় আগুন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কারণে দৌড়াদৌড়িতে নারী শ্রমিকরা বেশিরভাগ েেত্র পদদলিত হয়ে মারা যান।

জানা যায়, হাতেগোনা কিছু গার্মেন্টে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম থাকলেও বেশিরভাগ গার্মেন্টে তা নেই। এমনকি ঢাকার অনেক গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি ফায়ার সার্ভিসের 'ফায়ার লাইসেন্স'ও নেয়নি। দেশের ৮০ শতাংশ ফ্যাক্টরি তাদের শ্রমিকদের অগ্নিনির্বাপণ ও আত্দরার কোনো প্রশিণ দেয় না। অনেক ফ্যাক্টরিতে বিকল্প সিঁড়ি থাকলেও তা ব্যবহার করা হয় গোডাউন হিসেবে। পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে মনিটরিং করতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রি. জে. (অব.) আবু নঈম মোহাম্মদ শাহিদ উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'অনেক গার্মেন্টে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করার জন্য খুব একটা মহড়া দেওয়া হয় না। ওই ফ্যাক্টরিগুলোতে বিকল্প সিঁড়ি থাকলেও লবিকে গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে ফায়ার টিম ইন্সপেকশনে গেলে গার্মেন্ট কর্তৃপ পয়সা বাঁচানোর জন্য সময় নষ্ট করতেন। তাদের অসহযোগিতার কারণে অনেক সময় ইন্সপেকশন টিম ফায়ার ড্রিল না করেই ফিরে আসত। এ সংক্রান্ত  প্রতিবেদন প্রতি বছর বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে অবহিত করা হত। কিন্তু তারপরও সরকার ও কারখানা মালিকদের উদাসীনতার কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেই যাচ্ছে।'

পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'যেসব পোশাক কারখানা আমাদের সদস্য নয় তারাই সুষ্ঠু কর্মবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছে না। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু তাজরীনের দুর্ঘটনার পর বিজিএমইএ একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এর মাধ্যম কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের কর্মবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা হচ্ছে কিনা তা দেখা হচ্ছে। কারখানায় কাজের সময় বহিঃনির্গমন পথ বন্ধ রাখা আইনত ও মানবিকভাবে একটি অমার্জনীয় অপরাধ।

গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি, শ্রমিকনেত্রী মোশরেফা মিশু বলেন, নারী শ্রমিকদের এ করুণ মৃত্যু এটিই প্রমাণ করে যে, সরকার তাদের সঙ্গে অবিচার করছে। আইএলও কনভেনশনে কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ে বলা হলেও বাস্তবে কারখানা মালিকরা তা মানছেন না। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সরকার ও মালিকপকে এ ব্যাপারে যথাযথ দায়িত্ব নিতে হবে। ১৯৬৫ সালের কারখানা আইন ও আইএলও কনভেনশন বাস্তবায়ন করা গেলেই কারখানায় সুস্থ পরিবেশ তৈরি হবে। সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, 'আমরা চাই না দেশের শ্রমিকরা আর আগুনের শিকার হোক। সভ্য সমাজে মানুষদের পুড়ে এভাবে খড়ি হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি জাতির জন্য লজ্জিত ও নিন্দনীয়। শ্রমিকদের কাজ করার সময়ে তালা দেওয়ার বিষয়টি বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে পোশাক কারখানার গোডাউনে যাতে কোনো রকম বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও বয়লার না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

0 Response to "মৃত্যু ফাঁদে নারী শ্রমিক"

Post a Comment