কোর্ট পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা একটি স্পর্শকাতর মামলায় মাত্র সাত দিনের মাথায় জামিন বাগিয়ে নিয়েছে এক আসামি। দ্রততম সময়ে জামিন পেতে জালিয়াতির মাধ্যমে মামলার নথি থেকে মেডিকেল রিপোর্ট, হলফনামাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণাদির কাগজপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। জামিনে বেরিয়ে এসে আসামি বাদীকে মামলা তুলে না নিলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছে। এ অবস্থায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে বাদী ও তার পরিবার। এটি শুধু একটি ঘটনার েেত্র নয়, এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত।
মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, দুই লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে হত্যাচেষ্টা এবং সাধারণ ও গুরুতর জখমের অভিযোগে স্বামী মো. সাহিদ আক্তারসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক),(খ),(গ)/৩০ ধারায় গত ৭ অক্টোবর অভিযোগ আনেন বাদী চান্দা। অভিযোগটি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন আইনজীবী খন্দকার মুজাহিদুল হক। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ হলফান্তে বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ, হলফনামা ও মেডিকেল রিপোর্ট পর্যালোচনার পর অভিযোগটি পিটিশন মামলা (নম্বর ২২৮/১২) হিসেবে গ্রহণ করেন। একই দিন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা জজ) এস এম রেজানুর রহমান উল্লেখ করেন, 'অভিযোগটি তদন্তের জন্য সন্তোষজনক উপাদান রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।' তিনি বাদীর নালিশি দরখাস্তটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজুর পর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। বিচারক ওই আদেশে উল্লেখ করেন, অভিযোগকারিণী এফিডেভিট, নতুন ওকালতনামা ও অন্যান্য কাগজপত্রসহ (ফিরিস্তি ফরম ও মেডিকেল রিপোর্ট ইত্যাদি) অভিযোগ আমলে নেওয়ার প্রার্থনা করেছেন।
বিচারক রেজানুর রহমান তার আদেশে আরও উল্লেখ করেন, 'হলফনামার ফটোকপিসহ আদেশের অনুলিপি মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, ঢাকা বরাবর প্রেরণ করা হোক। তিনি হলফনামায় বর্ণিত অভিযোগ সম্পর্কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ... মামলাটি যথারীতি রুজু হয়েছে কি না তা ট্রাইব্যুনালকে জরুরি ভিত্তিতে জানানোর জন্য পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া গেল।' পল্লবী থানা নির্দেশ পাওয়ার পর যথারীতি বাদীর নালিশি দরখাস্তটি নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু করে, যার নম্বর ৬৭(১০)১২।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ইজাজুল ইসলাম ১ নং আসামি মো. সাহিদ আক্তারকে গত ২৪ অক্টোবর গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করেন। কিন্তু আশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে সাত দিনের মাথায় ৩১ অক্টোবর পুট-আপ দাখিল করে বাদীর অনুপস্থিতিতে মহানগর হাকিম এরফান উল্লাহর আদালত থেকে আসামি জামিন লাভ করে। বিচারক এরফান উল্লাহ জামিন আদেশে উল্লেখ করেন, মামলাটি তিনি দেখলেন। বাদীর অভিযোগের পে কোনো মেডিকেল কাগজপত্র নাই। তাই জামিন মঞ্জুর করা হলো। এত দ্রুততার সঙ্গে এমন একটি স্পর্শকাতর মামলায় জামিন হওয়ায় বাদীর আইনজীবী খোঁজখবর করা শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি আদালতের নারী ও শিশু জিআর শাখায় গিয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সামনে নথি ঘেঁটে দেখতে পান, বাদীর দাখিল করা হলফনামা, ফিরিস্তি ফরম, মেডিকেল রিপোর্ট, এমনকি আইনজীবী হিসেবে আদালতে দেওয়া তার ওকালতনামা কিছুই মামলার নথিতে নেই। বাদীর আইনজীবীর আওতায় থাকা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা নালিশি দরখাস্ত ও অন্যান্য কাগজপত্রের রতি অনুলিপিতে দেখা যায়, মেডিকেল রিপোর্টের কী কী কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ রয়েছে হলফনামায়।
আর এ জন্যই মামলার নথি থেকে হলফনামা সরানোর পর গায়েব করে ফেলা হয়েছে মেডিকেল রিপোর্ট-সংক্রান্ত সমস্ত কাগজ। আর এটিকে পুঁজি করেই অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে বাগিয়ে নেওয়া হয়েছে জামিন। এদিকে জামিনে বের হয়ে এসে বাদী চান্দার বাসায় গিয়ে মামলা তুলে না নিলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয় আসামি সাহিদ। বাদী এ বিষয়ে পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নম্বর ১৩/৩২) করে মহানগর হাকিম এরফান উল্লাহর আদালতকে জানান এবং তার জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে একাধিকবার আইনজীবীর মাধ্যমে আসামির জামিন বাতিলের আবেদন করেন। আদালত সাধারণ ডায়েরির তদন্ত প্রতিবেদন চান। তদন্ত প্রতিবেদনে আসামি বাদীকে যে মামলা তুলে না নিলে প্রাণে মেরে ফেলা হবে, এর সত্যতা মেলে। বিষয়টি আদালতের নজরে এনে আবারও আসামির জামিন বাতিল চান বাদীর আইনজীবী। কিন্তু আদালত জামিন বাতিল না করে বহাল রাখেন। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়, আসামি এমন একটি স্পর্শকাতর মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় পুনরায় বিয়ে করে রীতিমতো ঘর-সংসার করছে।
বাদী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বহুবার অন্য আসামিদের গ্রেফতার ও আলামত উদ্ধারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু তিনি তাদের ধরতে পারবেন না, কোনো আলামতও তার পে উদ্ধার করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন। বাদী মনে করেন, এ জালিয়াত চক্রের সঙ্গে অনেকেই জড়িত। মামলাটির সার্বিক নথি পর্যালোচনায় বোঝা যায়, এই জালিয়াত চক্রের সঙ্গে শুধু কোর্ট পুলিশ জড়িত নয়, মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও জড়িত। অর্থাৎ কোর্ট পুলিশ, আসামি, তদন্ত কর্মকর্তা একই সিন্ডিকেটের সদস্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাদীর আইনজীবী খন্দকার মুজাহিদুল হক বলেন, 'ভাবতে অবাক লাগে, আদালতে এমন জালিয়াত চক্র সক্রিয়। বাদীর হলফনামা, ফিরিস্তি ফরম, মেডিকেল রিপোর্ট, ট্রাইব্যুনালে আমার দাখিল করা ওকালতনামা ও মামলা প্রমাণের জন্য সংযুক্ত অন্যান্য কাগজপত্র যেভাবে জালিয়াত চক্র সরিয়ে ফেলেছে, এতে শুধু আসামির দ্রুততম সময়ে জামিনই হয়নি, মামলাটির ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। থলের বিড়াল খুঁজে বের করে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আমি আদালত ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপকে অনুরোধ জানাই। তা না হলে মানুষ তার শেষ আশ্রয়স্থল আদালতের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে।' মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে জিআরও (পল্লবী) সেলিম রেজা কোনো সদুত্তর না দিয়ে বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যান।
0 Response to "জালিয়াত চক্রের নেতৃত্বে কোর্ট পুলিশ"
Post a Comment