.

বীর বাঙ্গালী নিরব দীর্ঘ ২ বছর সোমালিয়া জলদস্যূদের হাতে সাত বাংলাদেশী বন্দি


যদি আমরা দেশ ও দেশের জনগনকে মূল্যায়ন করতে না পারি তা হবে বিশ্ব দরবারে বাঙ্গালী জাতির চরম অবমূল্যায়ন। পণবন্দি সাত নাবিকের মুক্তির জন্য সক্রিয় অবদান দরকার। দেশবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে, সরকারকে তার সঠিক দায়ীত্ব পালন করতে হবে। অর্থ দিয়ে হোক আর সেনা অভিযান করে হোক দেশের সন্তানদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। 

মালয়েশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ 'এমভি আলবেদো'-তে মোট নাবিক ছিলেন ২২ জন। এর মধ্যে সাতজন বাংলাদেশি। বাকিরা পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইরান ও ভারতের নাগরিক। কেনিয়াগামী জাহাজটি আরব সাগরে কোচিন বন্দরের কাছাকাছি সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে। দস্যুরা জাহাজটি ছিনতাই করে সব নাবিককে পণবন্দী করে। এ ঘটনা ঠিক দুই বছর আগে ২০১০ সালের নভেম্বরের। পরে জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ইরান সরকার আলবেদোতে আটকে পড়া তাদের নাবিকদের উদ্ধার করে। কিন্তু দুই বছরেও উদ্ধার হননি বাংলাদেশের জিম্মি সাত নাবিকের একজনও। জলদস্যুরা হুমকি দিয়েছে, আগামী এক মাসের মধ্যে তাদের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ না নিলে তারা একে একে হত্যা করে জিম্মিদের লাশ ভাসিয়ে দেবে সাগরে। কিছু দিন আগে এভাবে হত্যা করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় এক ভারতীয় নাবিককে। জিম্মি বাংলাদেশি নাবিকদের আত্দীয়স্বজন অভিযোগ করেছেন, দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের উদ্ধারে কোনো উদ্যোগই নেয়নি সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। দস্যুদের দাবি করা দুই কোটি ৪০ লাখ টাকার জন্য মৃত্যুমুখে রয়েছেন এই সাত নাবিক। হতভাগ্য পরিবারের বার বার তাগিদ সত্ত্বেও বন্দী নাবিকদের খোঁজ নেওয়ারও আর প্রয়োজন বোধ করছে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

জানা যায়, ২০১০ সালের নভেম্বরে মালয়েশীয় পতাকাবাহী এমভি আলবেদোকে নিয়ে ওই নাবিকরা যাচ্ছিলেন কেনিয়ায়। জাহাজটি আরব সাগর জলসীমায় ভারতের কোচিন বন্দরের কাছাকাছি জলদস্যুদের কবলে পড়ে ২৬ নভেম্বর। সোমালীয় সশস্ত্র জলদস্যুরা এর পর আলবেদোকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় সোমালীয় উপকূলবর্তী গারাকাড এলাকায়। জাহাজে ছিলেন এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ও ছয় নাবিক এবং বাংলাদেশের সাত, শ্রীলঙ্কার ছয় এবং ভারত ও ইরানের একজন করে নাবিক। বাংলাদেশিরা হলেন গোলাম মোস্তফা (সাতক্ষীরা), মো. আমিনুল ইসলাম (কুমিল্লা), মো. হাবিবুর রহমান (সাতক্ষীরা), মো. জাকির হোসাইন (চাঁদপুর), লিমন সরকার (চাঁদপুর), মো. আবুল কাশেম সরকার (সাতক্ষীরা) ও নুরুল হক (সাতক্ষীরা)।

হতভাগ্যদের পারিবারিক সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ৩১ জুলাই অপহৃত সাত বাংলাদেশি জাহাজটিতে কাজে যোগ দেন। ঢাকার বিএনএফ মেরিন সার্ভিস ও চট্টগ্রামের এভার শিয়ার মেরিন সার্ভিসেস নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ওই জাহাজের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এর পর ৬ নভেম্বর শুরু হয় কেনিয়া অভিমুখে জাহাজের যাত্রা। জলদস্যুদের কাছে জিম্মি নাবিক আমিনুল ইসলামের বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে ওরা জলদস্যুদের হাতে আটক আছে। অমানবিক বন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। আগে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ হলেও এক বছর ধরে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমরা সবশেষ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাই। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশের নাগরিক আটক হলে তাদের সরকার তাদের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।

সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে নোঙর করার পর ৫০ লাখ ডলারের মুক্তিপণ নিয়ে মালয়েশীয় বেসরকারি মালিক পক্ষের সঙ্গে দরকষাকষি চলে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি। পরে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে নাবিকদের মুক্ত করার বিষয়ে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ইরান ও ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে পাকিস্তান তাদের নাবিকদের ছাড়িয়ে আনার ব্যাপারে নিজেরাই উদ্যোগ নেয়। তাদের সরকার জিম্মিদের আত্দীয়স্বজন এবং দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় ও নিজস্ব তহবিল থেকে চার লাখ ডলার সংগ্রহ করে। এর পর তারা দুবাইয়ের এক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে যোগাযোগ করে সোমালীয় জলদস্যুদের সঙ্গে। সমঝোতা হওয়ার পর এ সাতজনকে আলবেদো থেকে নামিয়ে অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে দুবাই থেকে বিমানে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানে। গত ১ আগস্ট পাকিস্তান সরকার তার নাবিকদের ফেরত পেয়েছে।

বন্দী আমিনুলের পরিবার জানায়, আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশি মালিকানাধীন এমভি জাহানমনির নাবিকদের উদ্ধারে যিনি ভূমিকা রেখেছিলেন সেই ক্যাপ্টেন ফয়সাল আজিজের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি জানিয়েছেন বিদেশি একটি সংস্থা এ ব্যাপারে সহায়তা করতে আগ্রহী আছে। কিন্তু সরকার অনুমতি না দিলে ওই সংস্থা কোনো কিছুই করতে পারবে না। নাবিদের স্বজনদের দেওয়া তথ্যমতে, জলদস্যুরা ১১ লাখ ডলার তিন দেশের নাগরিকদের জন্য ভাগ করে দেয়। এতে বাংলাদেশের নাবিকদের জন্য পড়ে তিন লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা। আমিনুলের বরাত দিয়ে তার বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে টাকা না দিলে জলদস্যুরা তাদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। বিষয়টি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালককে জানানো হয়েছে। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল এবং নাবিক কল্যাণ ও সাহায্য-সহযোগিতার জন্য সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন নাবিক ওয়েলফেয়ার ফান্ড ডেফার্ড ক্রেডিট স্কিম ফান্ডের সহযোগিতা কামনা করছি। কারণ এর আগে জাহানমনিও মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের ক্ষেত্রে কেন হবে না। জাহাজটিতে বন্দী নাবিক লিমন ও জাকির হোসেনের বাড়ি চাঁদপুরে। সেই জেলার নির্বাচিত সংসদ সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। লিমনের বাবা ওয়ালিউল্লাহ বলেন, ছেলের আটকের খবর শোনার পর থেকেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তার যারা কাছের মানুষ তারা সময়-সুযোগ করে দিচ্ছেন না। লোক লাগিয়েও মন্ত্রীর কাছে যে ছেলে উদ্ধারে সহযোগিতা চাইব তা পারছি না।

পরিবারের সদস্যদের দাবি, গত বছর ১৮ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে একটি সভা হয়েছে। কিন্তু কী সিদ্ধান্ত হয়েছে তা তারা জানেন না। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেও এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বন্দীদের বিস্তারিত ঠিকানাও নেই মন্ত্রণালয়ে। তবে ২০১১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, পাকিস্তানের বন্দর ও জাহাজ মন্ত্রণালয় হাইকমিশনকে জানিয়েছে যে কমপক্ষে পাঁচ বাংলাদেশি নাবিক জিম্মি হয়েছেন। মালয়েশিয়ার জাহাজ এমভি আলবেদো ও পানামার জাহাজ এমভি আইসবার্গ ছিনতাই হয়েছে। এ জাহাজ দুটিতে বাংলাদেশিসহ কিছু পাকিস্তানি ও শ্রীলঙ্কান নাগরিক রয়েছেন। পাকিস্তানি নাগরিকদের উদ্ধারে পাকিস্তান সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে। হাইকমিশন থেকে আরও জানানো হয়েছে, ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাইকমিশনার খুব শীঘ্রই পাকিস্তানের বন্দর ও জাহাজ মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন জিম্মি বাংলাদেশিদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য। পাকিস্তানের মন্ত্রীর সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য জিম্মি বাংলাদেশিদের সম্পর্কে তথ্য জানা থাকলে হাইকমিশনকে জানানোর জন্য অনুরোধও করা হয়। কিন্তু সে বিষয়টি আর এগোয়নি। বিদায়ী পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস ও কনস্যুলার অনুবিভাগের মহাপরিচালক সুলতানা লায়লা হাসান এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি। নৌবাণিজ্য অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশি সাত নাবিক ওই জাহাজে উঠেছেন করাচি থেকে। বাংলাদেশের কোনো শিপিং এজেন্টের মাধ্যমে তারা চাকরি না নেওয়ায় তাদের বহির্গমনের তথ্য এ দেশে নেই। সরকার মনে করছে, নিয়মানুযায়ী জিম্মি হওয়া জাহাজের মালিকপক্ষকেই এ অর্থ প্রদান করতে হবে। এখানে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ দেওয়ার কোনো বিধান নেই। সাবেক কূটনীতিক গোলাম কাদের বলেন, গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সোমালিয়ার সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি ও দস্যুতার ওপর কোনো কর্তৃপক্ষেরই কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশটিতে কার্যকর কোনো সরকারও নেই। যারা শাসন করছে তারাও জলদস্যুদের নীরবে সমর্থন দিচ্ছেন। এ কারণে জলদস্যুদের প্রভাব সেখানে অনেক বেশি। জলদস্যুতাই সেখানে আয়ের মূল উৎস। এ কারণে তাদের সঙ্গে মুক্তিপণের সমঝোতা ছাড়া ছিনতাইকৃত জাহাজ কিংবা জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করা সম্ভব নয়। গোপনে হলেও সমঝোতা করেই বাংলাদেশের নাবিকদেরও মুক্ত করতে হবে। আর এর আগে যেখানে জাহানমনির জন্যও মুক্তিপণ দিতে হয়েছে সেখানে এই সাত জিম্মি নাবিককেও মুক্তিপণের বিনিময়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে বলে তার পরামর্শ।

0 Response to "বীর বাঙ্গালী নিরব দীর্ঘ ২ বছর সোমালিয়া জলদস্যূদের হাতে সাত বাংলাদেশী বন্দি"

Post a Comment